বর্ষার এক বিষণ্ন বিকেলে ব্যস্ত সড়কে দাড়িয়ে কাঁদছিল হাসনা বানু নামের ৮ বছরের এক শিশু। পথচারীদের কেউ কেউ কান্নার কারণ জানতে চাইলে সেদিন কিছুই বলতে পারেনি হাসনা বানু। সেদিনের সেই বিকেলে দেবদূত হয়ে হাসনাকে বুকে টেনে আশ্রয় দেন একজন সাদা মনের মানুষ মাহাবুবুল হাসান। সময়টা ২০০৮ সালের জুলাই মাস। চট্টগ্রামের রাউজানের ব্যস্ত সড়কে স্বজনদের হাত থেকে হারিয়ে যায় শিশু হাসনা বানু। এরপর কেটে গেছে ১৩টি বছর। এই দীর্ঘ সময়ের পর জাতীয় তথ্যভাণ্ডারকে কাজে লাগিয়ে ও কয়েকজন সরকারি কর্মচারীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় মাত্র আট বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া হাসনা বানু খুঁজে পেলেন তার পিতা-মাতাকে। ১৩ বছর পর নিজ পরিবারে ফিরে যেতে পেরে আবেগে আপ্লুত হাসনা। তার এই পরিবারে ফিরে আসার গল্প যেন কল্পনাকেও হার মানিয়েছে।





সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, হাসনা বানু ২০০৮ সালের জুলাই মাসে পিতা-মাতার কাছ থেকে দুর্ঘটনাবশত হারিয়ে যান চট্টগ্রামের রাউজানে। তার গ্রাম ছিল পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায়। ভাগ্যের অন্বেষণে এক সময় তার বাবা-মা রাঙ্গামাটিতে বসতি গড়েন। হারিয়ে যাওয়ার পর রাউজানের এক সহৃদয় ব্যক্তি সে সময় হাসনা বানুকে খুঁজে পান। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে ওই ব্যক্তি হাসনা বানুকে নিজের কাছে না রেখে ২০০৮ সালের ১২ আগস্ট তৎকালীন চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে কর্মরত অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার মাহবুবুল হাসানের পরিবারে হস্তান্তর করেন। ২০০৮ সাল থেকেই নিজের মেয়ের মতোই তিনি লালন-পালন করতে থাকেন হাসনা বানুকে।
মাহবুবুল হাসান ২০১৯ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েটিকে সুপাত্রের হাতে তুলে দিতে এ বছর প্রস্তুতি শুরু করেন মাহবুবুল হাসান। এক্ষেত্রে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রয়োজন জন্ম নিবন্ধন সনদ এবং এনআইডির। পিতা-মাতার খোঁজ নেই যে মেয়েটির, তার এনআইডি কিংবা জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরি করতে গত ২১ মে মাহবুবুল হাসান পরামর্শ করেন তার অগ্রজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রির স্বনামধন্য অধ্যাপক ড. মো. মোজাফফর হোসাইনের সাথে। অধ্যাপক মোজাফফর হোসাইন তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রাক্তন ছাত্র সত্যজিতকে ফোন দেন। সত্যজিত রায় দাশ হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। নিজের প্রিয় শিক্ষকের কাছ থেকে হাসনা বানুর বিবরণ জেনে তার পিতা মাতাকে খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেন ইউএনও সত্যজিত।





আট বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট হাসনা বানু তার স্মৃতিতে পিতা এবং মাতার নাম ব্যতীত অন্য কোনো তথ্যা মনে করতে পারেনি। কেবলমাত্র এই দুটি নাম দিয়ে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে থেকে তার পিতা-মাতাকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব বিষয়। এক্ষেত্রে সত্যজিত সহযোগিতা নেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজপ্রতিম বেদারুল ইসলামের। তিনি টেকনাফের উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। বেদারুল ইসলামকে জাতীয় তথ্যভাণ্ডার থেকে মেয়েটির বাবা-মাকে খুঁজে বের করার একটি কার্যকর প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে অনুরোধ জানান ইউএনও সত্যজিত।
বেদারুল জাতীয় তথ্যভাণ্ডার থেকে কেবলমাত্র মেয়েটির পিতা ও মাতার নাম দিয়ে অনুসন্ধান করে শত শত নামের মধ্যে থেকে কাঙ্ক্ষিত পরিবারটিকে খুঁজে বের করার প্রয়াস চালান। বিশাল ডাটাবেজ থেকে হাসনা বানুর পিতা-মাতাকে শনাক্ত করতে ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ পদ্ধতি অনুসরণ করেন তিনি। শুক্রবার রাত সাড়ে এগারোটায় রাঙ্গামাটি লংগদু উপজেলার মাইনীমুখ এলাকায় দুই বোনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয় যাদের পিতা-মাতার নামের সাথে হাসনা বানুর দেয়া বিবরণ এর আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বেদারুল রাতেই বিষয়টি ইউএনও সত্যজিতকে অবহিত করেন। তাৎক্ষণিকভাবেই সত্যজিত তার ব্যাচমেট লংগদুর ইউএনও মঈনুল আবেদীন মাসুদের নজরে আনেন এবং তাকে এই পরিবারটির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যাদি অনুসন্ধানের জন্য অনুরোধ করেন।





পরদিন শনিবার ইউএনও মাইনুল আবেদিন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের সহায়তায় পরিবারটির তথ্যাদি সংগ্রহ করেন এবং তাদের একটি কন্যা সন্তান রাউজানে হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। হাসনা বানু পরিবারকে লংগদুতে খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি মেয়েটির আশ্রয়দাতা মাহবুবুল হাসান এবং অধ্যাপক ড. মো. মোজাফফর হোসাইনকে নিশ্চিত করলে তাদের পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। হাসনা বানু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন তার পিতা-মাতাকে একনজর দেখার জন্য।
গত রবিবার সকালে লংগদুর ইউএনও মাইনুল আবেদিন মাসুদের ডাকে সাড়া দিয়ে তার কার্যালয়ে সশরীরে উপস্থিত হন হাসনা বানুর পিতা মজিবুর রহমান এবং মাতা ফরিদা বেগম। বেলা ১২টায় ইউএনও সত্যজিত মেয়েটিকে এবং তার পিতা-মাতাকে ভিডিও কলে সংযুক্ত করেন। এ সময় ভিডিও কলে যুক্ত ছিলেন মেয়েটির আশ্রয়দাতা মাহবুবুল হাসান, অধ্যাপক ড. মো. মোজাফফর হোসাইন, ইউএনও লংগদু মঈনুল আবেদীন মাসুদ, ইউএনও বাহুবল স্নিগ্ধা তালুকদার, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা টেকনাফ বেদারুল ইসলাম। দীর্ঘ ১৩ বছর পরে হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফিরে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন হাসনা বানুর পিতা-মাতা। হাসনা বানুর চোখে জল গড়িয়ে পড়ে অঝোর ধারায়। তাদের আবেগঘন মিলন দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ভিডিও কলে সংযুক্ত অন্য সকলেও।
কেবলমাত্র সরকারের তথ্যভাণ্ডারের ওপর নির্ভর করে দীর্ঘ ১৩ বছর হাসনা বানু ফিরে পায় তার পিতা-মাতাকে। মাত্র ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় তথ্যভাণ্ডার ১৩ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া হাসনা বানুকে ফিরিয়ে দিয়েছেন তার পিতা-মাতার কাছে। হাসনা বানুর পিতা মাতা ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে এবং সরকারি কর্মচারীদের কর্মনিষ্ঠা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় ফিরে পেলেন ৮ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া তার অত্যন্ত আদরের মেয়েটিকে।
চুনারুঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সত্যজিত দাস চৌধুরী বলেন, আমি চিন্তাও করতে পারিনি এই কাজ করতে পারব। প্রথমে সারাদেশের তথ্য থেকে ৮-৯শ নাম মিলে গেলে সেখান থেকে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে নাম যুগল পাওয়া যায় ৩০-৪০টি। পরে সেখান থেকে মূল লোককে পাওয়া যায়। এই সফলতা আমাদেরকে নতুন সম্ভাবনা দেখিয়েছে। সম্মিলিতভাবে কাজ করলে মিনিমান তথ্য দিয়ে যেকোনো বিষয় খুঁজে বের করা সম্ভব হবে বলে আমাদের বিশ্বাস সৃষ্টি করেছে এই ঘটনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ ও জাতীয় তথ্যভাণ্ডারের জন্য আজ আমরা এই কাজটি করতে পেরেছি।





তিনি আরও জানান, হাসনা বানুর বাবা-মা তাদের মেয়ের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তাদের মিলন হয় সে ছিল এক অপরূপ দৃশ্য। আমরা ২/১দিনের মধ্যেই বাস্তবে তাদের মাঝে মিলন ঘটাবো। আর হাসনা বানুর সাথে যে বিয়ের আলোচনা হয়েছে সেটি শিগগিরই প্রশাসনের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হবে।
রবিবার সকালে রাঙামাটির লংগদু উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে হাজির হাসনার পিতা-মাতা। কিন্তু মেয়ের ছোটবেলার ছবি দেখেও তারা চিনতে পারেননি হাসনাকে। এবার ভিডিও কলের মাধ্যমে নানা আলোচনা আর স্মৃতিচারণ শেষে নিজেদের আদরের ধন হারিয়ে যাওয়া হাসনাকে চিনকে পারেন তারা। সেদিনের সেই ভিডিও কলে যারা যুক্ত ছিলেন তারা সকলেই এ মহামিলনের দৃশ্য দেখে চোখের জল মুছেছেন। হাসনা ছিলো বাকরুদ্ধ। জন্মদাতা পিতা-মাতার কোনো স্মৃতি তার মনে নেই। জীবনের এক নতুন অধ্যায় তার সামনে দাঁড়িয়ে। শিগগিরই হাসনা তার পিতামাতার সাথে চট্টগ্রামে মিলিত হবে।
এ যেন এক জীবনের আড়ালে আরেক জীবনের গল্প। তথ্য প্রযুক্তি আর কিছু মহানুভব মানুষের কল্যাণে অসম্ভবকে সম্ভব করার সত্য কাহিনি। কেবলমাত্র তথ্যভাণ্ডারের ওপর নির্ভর করে দীর্ঘ ১৩ বছর পর হাসনা বানু ফিরে পায় তার পিতা মাতাকে। ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে এবং সরকারি কর্মচারীদের কর্মনিষ্ঠ ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় নাড়িছেড়া আদরের সন্তানকে ফিরে পায় মজিবুর রহমান ও ফরিদা বেগম দম্পতি।





এ বিষয়ে লংগদু উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাইনুল আবেদীন বলেন, কেবলমাত্র সরকারের তথ্য ভাণ্ডারের ওপর নির্ভর করে দীর্ঘ ১৩ বছর পর হাসনা বানু ফিরে পায় তার পিতা-মাতাকে। মাত্র ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় তথ্যভাণ্ডার হাসনা বানুকে পিতা-মাতার কাছে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান প্রজন্মের আশা আকাঙ্ক্ষা ও শুভচেতনার বাতিঘর। তার স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে প্রতিনিয়ত হাসনা বানুর মতো হাজারো পরিবারের মুখে হাসি ফুটেছে বাংলাদেশজুড়ে।